রমজানের রোজার ইতিহাস || শুভ রমজান বাংলা 201৯ | রমজান মাস ২০১৯

রমজানের ইতিহাস তাৎপয ও ফজিলত




রমজানের রোজার পরিচয় ও হুকুম



ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে রোজা অন্যতম। আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে এই রোজাকে ফরজ করেছেন৷ এই ফরজ রোজা আদায়ের জন্য যে মাস নির্ধারণ করেছেন সেটি হলো রামাদান বা রমজান৷ রামাদান বা রমজান শব্দটা এসেছে আরবি মূল রামিদা বা আর রামাদ থেকে, যার অর্থ প্রচণ্ড উত্তাপ কিংবা শুষ্কতা। ইসলামিক বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে নবম মাস হলো এই রমজান মাস। এই মাসেই বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা রোজা পালন করে থাকেন। রমজান মাসে রোজা পালন ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়।
অন্য মাসের তুলনায় এ মাসে ইবাদতের সওয়াব বহুগুণ বেশি৷ এই মাসেই নাজিল হয়েছিল পবিত্র কুরআন। কোরআন নাজিলের রাতকে বলা হয় লাইলাতুল কদর। এই রাতে ইবাদত করলে হাজার মাসের ইবাদতের থেকে বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।
রোজা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘দিন’। আর আরবিতে এর নাম সাওম বা সিয়াম। যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার এবং সেই সঙ্গে যাবতীয় ভোগ-বিলাস, পঞ্চইন্দ্রিয়ের দ্বারা গুনাহের কাজ এবং (স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে) যৌনসংগম থেকে বিরত থাকার নাম রোজা। রোজা রাখার উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং নিজেদের কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরহেজগারি বা তাকওয়া বৃদ্ধি করা। তাকওয়ার মূল কথা হলো পাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য সদা সতর্ক থাকবে। মাঘ মাসের শীতের সকালে কেউ যদি এমন কোন সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে চলে যার দু’পাশ ক্ষেতে ভরপুর থাকে, মানুষের উপদ্রুব থেকে রক্ষার জন্য রাস্তার উভয় পাশে কাঁটা বিছানো থাকে, তাহলে শীত ও কাটা থেকে বাঁচার জন্য একজন পথিক যেমন খুব সতর্ক হয়ে এবং পরিধেয় বস্ত্র সংকুচিত করে দুহাত দ্বারা ধরে পথ চলে ঠিক তেমনিভাবে একজন মুমিন পাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য এ পৃথিবীতে জীবন অতিবাহিত করবে। রোজা তাকে এ চেতনায় শিক্ষা দেয়। এ চেতনা অর্জিত না হলে রোজা কোন কাজে আসবে না।




ইসলামি বিধান অনুসারে প্রতিটি সুস্থ সবল মুসলমানের জন্য রমজান মাসের প্রতিদিন রোজা রাখা ফরজ বা অবশ্য পালনীয়। বিনা কারণে রোজা ভঙ্গ করলে তাকে অবশ্যই কাজা-কাফফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব। যতটি রোজা ভঙ্গ হবে, ততটি রোজা আদায় করতে হবে। কাজা রোজা একটির পরিবর্তে একটি অর্থাৎ রোজার কাজা হিসেবে শুধু একটি রোজাই যথেষ্ট। আর কাফফারা আদায়ের তিনটি বিধান রয়েছে, একটি রোজা ভঙ্গের জন্য একাধারে ৬০টি রোজা রাখতে হবে, যদি কারও জন্য ৬০টি রোজা পালন সম্ভব না হয় তবে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খাওয়াতে হবে ও গোলাম বা দাসী আজাদ করে দিতে হবে।
বস্তুত সকল উম্মতের উপরই রোজা ফরয ছিল, যদিও রোজার সংখ্যা, ধরন ও অন্যান্য গুণাবলীর দিক বিবেচনায় পার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআন মজিদে এরশাদ হয়েছে, ‘হে ইমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। ’
‘সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৩’
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলুসি (রহ.) তার তাফসির গ্রন্থ রুহুল মাআনিতে বলেন, ‘এখানে পূর্ববর্তীদের বলতে হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হজরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত সব যুগের মানুষকে বোঝানো হয়েছে।’
হজরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি ওই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘রোজার হুকুম যুগ যুগ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে।’ (ফাওয়ায়িদে ওসমানি)।
তাফসিরের বর্ণনায় রয়েছে, আদম (আ.)-এর সৃষ্টির পর তাঁকে ‘নিষিদ্ধ ফল’ আহার বর্জনের যে আদেশ দিয়েছেন- এটাই মানব ইতিহাসের প্রথম সিয়াম সাধনা। ইতিহাসে আরো পাওয়া যায়, আদম (আ.) সেই রোজা ভাঙার কাফ্ফারাস্বরূপ ৪০ বছর রোজা রেখেছিলেন।
হযরত আদম (আ.)-এর রোজার ধরন কেমন ছিল তা সঠিকভাবে বলা যায় না। বলা হয়ে থাকে হযরত মুসা (আ.)ও ৩০ দিন রোজা রেখেছিলেন। তুর পাহাড়ে যাওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা তাকে আরও অতিরিক্ত ১০টি রোজা রাখার আদেশ দেন। ফলে তার রোজা হয়েছিল মোট ৪০ দিন। হযরত ঈসা (আ.)ও মুসা (আ.)-এর মতো ৪০ দিন রোজা রাখতেন। হযরত ইদ্রিস (আ.) সারা জীবন রোজা রেখেছিলেন। হযরত দাউদ (আ.) একদিন পর পর অর্থাৎ বছরে ছয় মাস রোজা রাখতেন।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিনদিন করে রোজা রাখার বিধান প্রচলিত ছিল। হজরত ইবনে মাসউদ, হজরত ইবনে আব্বাস, হজরত মুআজ, হজরত কাতাদা, হজরত আতা ও হজরত যাহহক (রহ.) এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনদিন করে রোজা রাখার নিয়ম হজরত নুহ (আ.) থেকে শুরু হয় এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত প্রচলিত থাকে।
তবে এ বিষয়ে অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ইহুদিরা ৪০ দিন রোজা রাখত। খ্রিস্টানরা রোজা রাখত ৫০ দিন। সর্বশেষ নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের জন্য ৩০ দিন রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। (সূত্র: বায়হাকি শরিফ ও ফাতহুল বারি)।
তাছাড়া প্রথম কবে ও কোন রোজা ফরজ করা হয়েছিল এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, ১০ মহররম অর্থাৎ আশুরায় রোজা ফরজ ছিল, আবার কারও কারও মতে, ‘আইয়ামুল বিজ’ অর্থাৎ প্রত্যেক চন্দ্র মাসে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা ফরজ ছিল। পরে রমজানের রোজা ফরজ হলে তা বন্ধ বা রহিত হয়ে যায়।
পুরো এক মাস পবিত্র রমজান মাসের রোজা রাখার আদেশ অবতীর্ণ হয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং সাহাবিদের মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরতের ১৮ মাস পরে। তখন আরবি শাবান মাস চলছিল।




এ সময় এ আয়াত নাজিল হয় ‘রমজান মাস, এ মাসেই নাজিল করা হয়েছে কোরআন মানুষের জন্য হেদায়েত, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। তবে কেউ রোগাক্রান্ত হলে অথবা সফরে থাকলে এ সংখ্যা অন্য সময় পূরণ করবে। আল্লাহ চান তোমাদের জন্য যা সহজ তা, আর তিনি চান না তোমাদের জন্য যা কষ্টকর তা, যেন তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করো এবং আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো, তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার জন্য এবং যেন তোমরা শোকর করতে পার।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)।
এ আয়াত নাজিলের পর আশুরার রোজা অথবা আইয়ামুল বিজের রোজা পালনের ফরজিয়াত মানসুখ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর হিজরি দ্বিতীয় সনে রোজা ফরজ হওয়ার আগ পর্যন্ত দু’ধরনের রোজার প্রচলন ছিল। ক. আইয়ামুল বিজ অর্থাৎ প্রত্যেক চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখা। খ. আশুরার দিন অর্থাৎ ১০ মহররমের দিন রোজা রাখা। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আব্বাস (রা.) এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, আগে রোজা ছিল এক সন্ধ্যা থেকে আরেক সন্ধ্যা পর্যন্ত। রাতে ঘুমানোর পরে পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পূরণ করা বৈধ ছিল না।

Post a Comment

0 Comments